বাণেশ্বরে কচ্ছপকে মোহন বলে। আর এই মোহনকে নিয়েই এক গল্প পড়ুন । কলমে অরিন্দম পাল, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, কোচবিহার হাইওয়ে সাব-ডিভিশন – 2অলোক বাবু দু হাত জোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে তারস্বরে বলে উঠলেন – “জয় মোহনের জয়”।কলমে অরিন্দম পাল
চোখ লেগে গিয়েছিল। ড্রাইভার ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করালে আমি আর সত্যদা সোজা হয়ে বসলাম। সামনে পথ অবরোধ। ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে গেল বিষয়টা জানতে। ফিরে এসে জানালো কচ্ছপ পাচার নিয়ে জনগণের রোষ।
আমি অবাক হয়ে বললাম – “কচ্ছপ!”
সত্যদা বললেন – “কচ্ছপ নয়, বল মোহন।”
- “মানে?”
- “আমরা এখন আছি বাণেশ্বরে। এখানে বাণেশ্বর শিব মন্দিরের পাশে শিবদিঘিতে অনেক কচ্ছপ আছে। কিছু কচ্ছপের বয়স একশোরও বেশি। স্থানীয় মানুষ এদের মোহন নামে ডাকে আর বিষ্ণুর কূর্ম অবতার রূপে পুজা করে। এখানকার ব্ল্যাক সফ্টশেল কচ্ছপ ওয়ান অফ দ্য রেয়ারেস্ট স্পিসিস।”
রাস্তার ধারে একটা সাইন বোর্ডে “DRIVE SLOW. TORTOISE CROSSING ZONE.” লেখা দেখে অবাকই হলাম। সত্যদা জানালো যে এদিকে অনেক খালবিল আছে আর কচ্ছপগুলো অনেক সময়ই এদিক থেকে ওদিক হাইওয়ে পারাপার করে থাকে।
- “বিষয়টা কি, চল তো একটু দেখা যাক” – বলে সত্যদা গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। আমিও পেছন পেছন গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।
সামনে ভিড়ের মধ্যে গেলে দেখা গেল একজন চশমা পরা চকচকে টাক মাথার ভদ্রলোক জনৈক নিউজ রিপোর্টারকে বাইটস্ দিচ্ছেন। চারপাশে ভিড় করে ক্যামেরায় স্থান করে নিতে চাইছে কিছু অত্যুৎসাহী লোকজন। লোকটা বাইটস্ দেওয়া শেষ করে এদিকে আসছিলেন আর তখনই সত্যদার ওপর চোখ পড়তেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাঁর। “আরে সত্য যে, তুই এখানে!” বলে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন সত্যদাকে। সত্যদাও পরিচিত মানুষ পেয়ে খুশি। পরিচয়ে জানা গেল, এই ভদ্রলোক সত্যদার একসময়ের বন্ধু, সত্যদার সাথে এক কলেজে পড়তেন। নাম অলোককৃষ্ণ রায়। বাড়ি কোচবিহার। বাণেশ্বর মোহন রক্ষা কমিটির সভাপতি।
- “তুই এদিকে কি কাজে?”
- “কোলকাতায় যা গরম, উত্তরবঙ্গে চলে এলাম ঘুরতে। এমনিতেই সামার ভ্যাকেশন। আলিপুরদুয়ারে মামাবাড়ি থেকে ফিরছি। তেমন কোনো প্ল্যান নেই। কোচবিহার যাচ্ছি। তারপর একটু পাহাড় জঙ্গল বেড়াবো আর কি।”
- “তা তোকে পেয়ে ভালোই হল। একটু দেখে দে না ব্যাপারটা। প্রচুর মোহন চোরাচালান হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই লুপ্তপ্রায় স্পেসিসটাকে আর রক্ষা করা যাবে না।”
- “কিন্তু, আমি… আমি কি দেখবো!” – একটু থতমত খেলেন সত্যদা।
- “আমি জানি তুইই পারবি এই পাচার চক্রের হদিশ করতে।”
- “পাচার চক্র!” – সত্যদা ভ্রূ কুঁচকালেন।
- “দীর্ঘদিন ধরে পাচার হচ্ছে ‘মোহন’। আজও দুটো মোহনকে বস্তাবন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে ওই রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ে। আরেকটু হলেই পাচার হয়ে যেত।”
- “তা কি করতে হবে পরিষ্কার করে বল তো।”
- “তোকে খুঁজে বের করতে হবে এই কালপ্রিটদের। এরা আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে।”
- “সেজন্য তো পুলিশ আছে।”
- “পুলিশ তো চেষ্টা করছেই। কিন্তু আমি তোকে জানি। তুই দায়িত্ব নিলে অপরাধী পার পাবে না।”
সত্যদা আমার দিকে তাকালে আমিও সম্মতিসূচক ইশারা করলাম। অগত্যা সত্যদা রাজি হলেন। অলোকবাবুও যেন একটু আশ্বস্ত হলেন। আমরা বাণেশ্বরেই থেকে যেতে চাইলে অলোকবাবু আমাদের থাকার আয়োজন করতে চাইলেন। কিন্তু এ তো আমাদের অতি পরিচিত জায়গা। এর আগে ভগীরথ খুনের তদন্তে অনেকটা সময়ই আমরা বাণেশ্বরে কাটিয়েছি। আমরা আমাদের পরিচিত হোম-স্টে তে গিয়েই উঠলাম।
আমরা হোম-স্টে তে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিলাম। কিছুক্ষণ বাদে অলোক বাবু এলেন। অবরোধ উঠে গেছে। প্রতীকী অবরোধ প্রশাসনের চোখ খোলানোর জন্য। এতেও কাজ না হলে এরপর ওঁরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নামবেন। অলোক বাবু আজ আমাদের সাথেই লাঞ্চ করলেন। লাঞ্চের সময় আলোচনা থেকে জানা গেল যে বহুদিন ধরে একটা বিষয় নিয়ে মোহন রক্ষা কমিটি আর বাণেশ্বরের স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ। সেটা হল, রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ি চাপা পড়ে কচ্ছপের মৃত্যু। এর আগেও বহুবার পথ অবরোধ হয়েছে। রাস্তাটি মেইনটেইন করে পি.ডব্লিউ.ডি। পি.ডব্লিউ.ডি-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ওরা কিছু স্পিড-ব্রেকার বসিয়ে দেয়। কিন্তু এ তো হাই রোড। দিনের বেলা সেরকম বোঝা না গেলেও রাতের দিকে মাল বোঝাই লড়িগুলো যখন স্পিড-ব্রেকারের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে অতিক্রম করে যায়, বাণেশ্বর বাজার এলাকায় হাইরোডের ধার ঘেঁষা বাড়িগুলো কাঁপতে থাকে। কিছু কিছু বাড়িতে ক্র্যাক দেখা দেয়। এ তো আরেক বিপত্তি। স্থানীয়দের চাপে বাধ্য হয়ে সেই স্পিড-ব্রেকার গুলো তুলে দেয় পি.ডব্লিউ.ডি।
- “তুলে দিল কেন? এবার তাহলে গাড়িগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণ হবে কিভাবে?” – জানতে চাইলাম।
- “সেটা তো কথা। কিন্তু কচ্ছপ বাঁচাতে গিয়ে তো আর মানুষের বিপদ ডেকে আনা যায় না।” – অলোক বাবু বললেন ।
- “আসলে ভাইব্রেশনের ওয়েভ টা ব্রেক করে দিলেই হয়ে যেত। মানে রাস্তা আর বাড়িগুলোর মাঝে ট্রেঞ্চ কেটে ড্রেন বানিয়ে দিলে বা তাতে ভাইব্রেশন অ্যাবসরভার হিসেবে বালি ভরে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।” – বললাম।
কথাগুলো যেন অলোক বাবুর মাথার ওপর দিয়ে গেল। উনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।
সত্যদা অলোক বাবুকে বললেন – “আয়ুশ যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। তাই ওর কথায় টেকনিক্যাল ছাপ দেখে ঘাবড়াবেন না।”
– “তাই বলি। সেজন্যই পি.ডব্লিউ.ডি-এর ইঞ্জিনিয়ার অনির্বাণ বাবু রাস্তার ধারে কতটা সরকারি জমি আছে সেটা দেখার চেষ্টা করছিলেন। উনিও সম্ভবত এরকমই কিছু একটা ভাবছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাস্তার পরে পি.ডব্লিউ.ডি-এর সেরকম জমি নেই বললেই চলে।”
কথাটা শুনে একটু হতাশই হলাম। অলোক বাবু জানালেন যে পি.ডব্লিউ.ডি যথেষ্ট সাইন বোর্ড, রোড মার্কিং-এর ব্যবস্হা করেছে এই জোনে। কিন্তু কোন ড্রাইভার আর এসব মানে! আগের স্পিড ব্রেকার গুলো ছিল প্লাস্টিকের এবং স্বপ্ল উচ্চতার। সেগুলো সরিয়ে পি.ডব্লিউ.ডি. থেকে পিচ দিয়ে বেশ বড় মাপের স্পিড ব্রেকার বানিয়ে দিয়েছে তাতে সাদা রং-ও করে দিয়েছে যাতে রাতে ড্রাইভারের চোখে পড়ে। এখন অন্তত স্পিড ব্রেকারের কাছে এসে লড়িগুলো স্পিড নামাতে বাধ্য হচ্ছে আর আশেপাশের বাড়িগুলোতে ভাইব্রেশনের প্রবলেমটাও আর নেই। তবে কচ্ছপ পারাপারের করিডোর টা এত লম্বা যে শুধু স্পিড-ব্রেকার দিয়ে কচ্ছপ বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। স্পিড-ব্রেকারের সামনে গাড়িগুলো স্পিড কমাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারপরেই যতটুকু স্পিড আপ করছে তাতেও অনেক কচ্ছপ মারা গেছে বিভিন্ন সময়ে। অনেক চিন্তাভাবনা করে পি.ডব্লিউ.ডি. থেকে একটা প্রোপোজাল ইনিশিয়েট করা হয়েছে যেখানে মোহন পারাপারের এই পুরো করিডোর জুড়ে ১২ টা মতন বক্স কালভার্ট আন্ডারপাস হিসেবে করা হবে আর রাস্তার দুই ধারে উঁচু করে কংক্রিটের ওয়াল দিয়ে রেলিং মতন করা হবে। এতে মোহনগুলো আর রাস্তায় উঠবে না, আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পার হবে। প্রোপোজাল যদিও এখনও অ্যাপ্রুভ হয়নি। চিন্তার বিষয় হল, এই প্রোপোজাল বাস্তবায়িত করার জন্য যে সার্ভে টিম এখানে কাজ করছিল, তারা এখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে সার্ভে করছিল। কাকতালীয়ভাবেই কিনা জানিনা, ঠিক সেসময় থেকেই মোহন পাচার হওয়ার ঘটনা শুরু হয়। এমনকি আশ্চর্যের বিষয় এই যে ওদের সার্ভের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ওরা ঘরটার ভাড়া ছাড়েনি। ওদের একজন এখনও মাঝে মাঝে এসে থাকে ওখানে।
- “স্ট্রেনজ!” – সত্যদা।
- “হ্যাঁ, আমার ভীষণ সন্দেহ ওই সার্ভে টিম বিশেষ করে ওই লোকটাকে যে এখনও এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করে।”
- “পি.ডব্লিউ.ডি বা পুলিশকে জানান নি?”
- “জানিয়েছি বইকি। পি.ডব্লিউ.ডি বলে কেউ ঘর ভাড়া নিয়ে থাকলে ওরা কি করতে পারে। পুলিশও তো কোনও সংকেত পায়নি যে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আরেকটা অদ্ভূত ব্যাপার, ঠিক এর পরপরই শিবদিঘিতে একের পর এক মোহন অসুস্থ হতে শুরু করে। অনেক মোহন মারাও যায়। এখন যদিও অবস্থা নিয়ন্ত্রণে কিন্তু ঠিক কি কারণে সেটা হচ্ছিল, তা এখনও বেরিয়ে আসে নি।”
- “আজকের উদ্ধার হওয়া মোহন দুটো কোথায় আছে?”
- “বন দপ্তরের লোক নিয়ে গেছে। শুশ্রূষা করে শিবদিঘিতে ছেড়ে দেবে।”
- “বিকেলে তাহলে একবার দেখতে যাবো ওদের।”
- “ঠিক আছে। আমি নিয়ে যাবো। এখন একটু রেস্ট করে নে তোরা। আমি মোহন রক্ষা কমিটির লোকজনদের সাথে একটু কথা বলে আসি।”
অলোকবাবু বেরিয়ে গেলেন। সত্যদা একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলতে লাগলেন – “মোহন এই এলাকার মানুষদের কাছে পূজনীয়, তাই এটা স্থানীয় কারোর কাজ নয়। অলোকবাবুর সন্দেহকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”
- “সত্যদা তুমি যে বলছিলে এখানকার মানুষ এদের ভগবান বিষ্ণুর কূর্ম অবতার হিসেবে পুজো করে, এই কূর্ম অবতারের কি যোগ এখানে?”
উত্তরে সত্যদা যা বললেন তাতে, ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার কূর্ম অবতার মানে কচ্ছপ অবতার। সত্য যুগের ঘটনা। একবার দুর্বাসা মুনি ইন্দ্র দেবকে একটা পারিজাত ফুলের মালা উপহার দিলে, দেবরাজ ইন্দ্র সেটা তাঁর ঐরাবতের গলায় পরিয়ে দেন। ঐরাবত ফুলের গন্ধ সহ্য করতে না পেরে শুঁড় দিয়ে মালাটা ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পাড়াতে লাগলো। এই ঘটনায় দুর্বাসা মুনি নিজেকে অপমানিত বোধ করে দেবরাজ ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে খুব শীঘ্রই দেবরাজ ও স্বর্গের বাকি দেবতাদের শ্রী বিলুপ্ত হবে। অভিশাপের ফলে কিছুদিনের মধ্যেই দানবরা দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য দখল করে। হতভাগ্য দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণু বলেন তাদের সমস্ত শ্রী ক্ষীরসাগরে তলিয়ে গেছে এবং সমুদ্রমন্থনই তাদের শ্রীবৃদ্ধির একমাত্র উপায়। বিষ্ণু বলেন দেবতাদের এই কাজ অসুরদেরকে সাথে নিয়েই করতে হবে। দেবরাজ ইন্দ্র সংশয় প্রকাশ করেন যে অসুরেরা কেন দেবতাদের সাহায্য করবে। বিষ্ণু জানান, সমুদ্রমন্থনের শেষে অমৃত বেরোবে আর এই কথা জানলে অসুরেরা অবশ্যই রাজি হবে। যদিও বিষ্ণু দেবতাদের আশ্বস্ত করেন যে তিনি ষড়যন্ত্র করে এমন ব্যবস্হা করবেন যেন ঐ অমৃত শুধুমাত্র দেবতারাই পান করতে পারেন। ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশমত দেবতারা দানববীর বলীর সাথে কথা বললেন। দানবদের সাথে কূটনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন করে শুরু হল সমুদ্রমন্থন। মন্দার পর্বতকে ক্ষীর সাগরে স্থাপিত করে শিবের স্কন্ধসঙ্গী নাগরাজ বাসুকীকে মন্থন রজ্জু হিসাবে ব্যবহার করা হল। মন্থনের সময় মন্দার পর্বত ক্ষীরসাগরে ডুবে যেতে থাকলে দেবতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই সময় ভগবান বিষ্ণু কূর্ম অবতার ধারণ করে ক্ষীরসাগরের নীচে গিয়ে নিজের পিঠের শক্ত খোলক দিয়ে মন্দার পর্বতকে ধরে রাখেন ও নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করেন। ভগবান বিষ্ণুর এই কূর্ম অবতারের ফলেই সমুদ্র মন্থন সফল হয়েছিল আর দেবতাদের অমৃত আস্বাদন, পুনরায় শ্রী ও স্বর্গরাজ্য লাভ সম্ভব হয়েছিল। এখানকার মানুষের বিশ্বাস, বাণেশ্বরের এই মোহনেরা ভগবান বিষ্ণুর কূর্ম অবতারের ধারক ও বাহক এবং আশ্চর্যের বিষয় হল এদের পিঠের খোলকের ওপরটা এরকম এবড়োখেবড়ো যেন এটাই মনে করায় সমুদ্রমন্থনের সময় মন্দার পর্বতকে পিঠে ধারণ করার জন্যই এরকম হয়েছিল।
বিকেলে অলোকবাবু বনদপ্তরের কাস্টডিতে থাকা মোহন গুলোর কাছে আমাদের নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখা গেল মোহন দুটো ভালো আছে। তাদের একটার গলা থেকে বড়শির কল বের করা হয়েছে, আরেকটার গলায় বড়শির কল এভাবে আটকে আছে যে সেটা সার্জারি ছাড়া বের করা সম্ভব নয়। মোহন গুলোর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে অদ্ভূত অনুভূতি হল এবং পিঠের এবড়োখেবড়ো স্পর্শ করে প্রাগৈতিহাসিক একটা অনুভূতি একমুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন করলো যেন। সত্যদা অদূরেই সিগারেট জ্বালিয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছেন। হঠাৎ একটা আশ্চর্য বিষয় উপস্হিত সকলকে চমকে দিল। সত্যদা সিগারেটের অবশিষ্ট টা মাটিতে ফেলে দিলে মোহন দুটো সিগারেটের ধোঁয়া অনুসরণ করে এগিয়ে এসে সিগারেটের বাটে মুখ লাগিয়ে ধূমপানের চেষ্টা করতে লাগলো। সত্যদা কৌতূহলের দৃষ্টিতে অলোক বাবুর দিকে তাকালে হতভম্ব অলোক বাবু ডান হাত দিয়ে টাক চুলকাতে লাগলেন। বন দপ্তরের স্টাফ সামনে ছিল, সেও বাকরুদ্ধ, এই ঘটনা জীবনে সে প্রথমবার দেখছে জানালো।
অলোক বাবু আমাদের আস্তানায় ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সারাদিন অনেক ধকল গেছে ভদ্রলোকের। অলক বাবু বহুদিন ধরেই এই অঞ্চলের মোহনদের ভালোবেসে তাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মোহনদের জন্য ওনার আবেগ চোখে মুখে ধরা পড়ে। সন্ধ্যায় আমি আর সত্যদা গেলাম বাণেশ্বর মন্দির। মন্দিরে ঢুকে মূর্তি দর্শন করলাম, প্রণাম করলাম। দেখলাম শিবের বাঁ পাশে একটি মূর্তি, যার ডান অঙ্গটি মনে হলো মহাদেবের ও বাম অঙ্গটি সম্ভবত দেবী দুর্গার। আমাকে একটু অবাক দেখাতে সত্যদা বলে উঠলেন – “এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তিটি শিব ও দুর্গার সম্মিলিত রূপ। দোল পূর্ণিমা ও মদন চতুর্দশীতে এই মূর্তিটিকে কোচবিহারের মদনমোহন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই জন্য মূর্তিটিকে চলন্তা বাণেশ্বরও বলা হয়।”
মন্দিরের ভেতরে পূর্ব দিকের দেওয়ালে একটি ধাপের উপর একটি অচেনা রকমের মূর্তি দেখে সত্যদাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “ওটা কি মূর্তি?”
- “স্থানীয় মানুষ দের মতে এটি বাণাসুর এর মূর্তি; মানে যার থেকে এই জায়গার নাম হয়েছে বাণেশ্বর।”
- “বাণাসুর শুনে কেমন যেন একটা অসুর অসুর মনে হচ্ছে।”
- “সে কি রে, অসুর-ই তো।”
- “অসুর, আর তার নামে কিনা শিবের মন্দির!” – আমি অবাক হয়ে।
উত্তরে সত্যদার থেকে যা জানতে পারলাম তা হল দ্বাপর যুগের শেষের দিকে এই উত্তরবঙ্গ, তখন যার নাম ছিল উজানীনগর, এখানে অসুর মহাবীর বলী রাজত্ব করতেন। এই মহাবীর বলীই দেবতাদের কূটনৈতিক চালে পা দিয়ে সমুদ্রমন্থনে দেবতাদের সাহায্য করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ স্বর্গরাজ্য হারান। এদিক থেকে দেখতে গেলে এই উজানীনগরে কূর্ম অবতারের ধারক ও বাহকের অস্তিত্ব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মহাবীর বলীর পুত্র বাণাসুর মহাপরাক্রমশালী হয়ে পুনরায় স্বর্গরাজ্য দখল করেন। কিন্তু, তার ইষ্টদেবতা মহাদেবের আদেশে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে যান। এরপরই বাণাসুরের মনে অনুশোচনা জন্ম নেয়। সে ভাবতে থাকে যে অমর দেবতারা স্বর্গের অধিপতি। অমরত্বের কারণ ইতিপূর্বেই সমুদ্রমন্থনে প্রাপ্ত অমৃত দেবতারা পান করেছেন। এই দেবতারা চাইলে তাকে বা তার প্রজাদেরকে তুলে নিয়ে গিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা দেবার জন্য যমের হাতে সমর্পণ করতে পারেন। তাই সে তার রাজ্যে কেউ মারা গেলে যাতে তাকে যমের হাতে না পড়তে হয় তার জন্য এক কঠিন তপস্যায় ইষ্টদেবতা শিবকে সন্তুষ্ট করে এই বর প্রার্থনা করেন যে শিবকে তিনি কৈলাস থেকে মর্ত্যে জল্পেশ্বরে তার রাজত্বে নিয়ে গিয়ে সেখানে মহাপূন্যতীর্থ দ্বিতীয় কাশীনগর স্থাপন করবেন। বাণাসুরের তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন ঠিকই, কিন্তু তার পরাক্রমে মনে মনে শঙ্কিতও হলেন। সে কারণে তিনি এক বিশেষ শর্ত আরোপ করলেন যে তাকে মাথায় নিয়ে বাণাসুরকে সূর্যোদয়ের পূর্বেই জল্পেশ্বর পৌঁছতে হবে। না হলে তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে না। শর্ত মাফিক বাণাসুর যাত্রা শুরু করলেও পথমধ্যে নারদ ও দেবতাদের ছলনায় কার্যসিদ্ধি করে উঠতে পারলেন না। ভগ্নহৃদয় দৈত্যরাজ বাণাসুর অবশেষে ইষ্টদেবতা শিবের কাছে করুণ মিনতি জানালে ভক্তের অনুনয়ে ব্যাথিত হয়ে শিব তাকে সেখানেই শিবস্থাপনের নির্দেশ দেন এবং আশীর্বাদস্বরূপ ভক্ত বাণাসুরের নাম নিজের নামের সাথে জুড়ে দিয়ে এই জায়গার নাম রাখতে বলেন বাণেশ্বর।
আমরা শিবদিঘির আশপাশেও ঘুরে এলাম। অন্ধকার নেমে আসায় খুব ভালো করে মোহনদের দেখা যাচ্ছিল না। আগে এই দিঘিতে মোহনদেরকে মুড়ি, মোয়া এসব খাবার দেওয়া যেত এবং খাবারের টানে মোহনগুলো ঘাটের কাছাকাছি এসে মুখ বাড়িয়ে খাবার খেয়ে বাচ্চা বুড়ো সবাই মজা পেত। কিন্তু এখন বাইরে থেকে খাবার দেওয়া বারণ। সম্ভবত শিবদিঘির মোহনরা একের পর এক অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার কারণে কতৃপক্ষ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এখন মোহনদের যাবতীয় খাবার কোচবিহার দেবত্ব ট্রাস্ট বোর্ডই দিয়ে থাকে। আলোচনার সময় অলোকবাবু প্রশাসনিক গাফিলতির প্রসঙ্গ টেনে অভিযোগ করছিলেন যে এদের খাবারদাবার ঠিক ভাবে দেওয়া হচ্ছে না। আর তাই হয়তো খাবারের সঙ্কুলান না হওয়ায় এদের কেউ কেউ রাস্তা পার করে অন্য খালবিলে চলে যেতে চায়। তাছাড়া শিবদিঘি নাকি ঠিকঠাক পরিষ্কার করা হয় না। বিভিন্ন রকম দূষণ এবং অবশিষ্ট খাবার থিতিয়ে পড়ে দিঘির জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে ফেললেও মোহনদের অসুবিধা হয়। সেটাও আরেক কারণ এদের জায়গা পরিবর্তনের। দূষণের মাত্রা বাড়ার কারণেই হবে হয়তো একের পর এক মোহনেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছিল বা মারা যাচ্ছিল। আমরা ঘাট বরাবর হেঁটে ফিরছি, সত্যদা অভ্যাসবশত সিগারেটের প্যাকেটটা পকেট থেকে বের করতেই আমি সামনের একটা সাইন বোর্ডের দিকে ইশারা করলাম – “ধূমপান নিষেধ।”
বাড়ি ফিরে ডিনার সেরে সত্যদা সিগারেট জ্বালিয়ে বলতে লাগলেন – “বড়শির কল দিয়ে মোহন দুটোকে ধরা হয়েছে মানে এরা শিবদিঘির কচ্ছপ নয়।”
- “তাহলে বলছো এদের আশেপাশের কোনো খালবিল থেকে ধরা হয়েছে।”
- “একদম, এ চত্বরে সব খালবিলেই কমবেশি মোহন আছে। কাল সকালে আশেপাশের সব খালবিল পরিদর্শন করতে হবে। প্রাথমিক ভাবে খোঁজ করতে হবে এই মোহন দুটিকে ঠিক কোন জলাশয় থেকে পাকড়াও করা হয়েছে।”
- “আর ওই যে সার্ভে করার মানুষটা যে এখানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে রেখেছে, ওকে একটু জেরা করা দরকার নয় কি?”
- “অবশ্যই, অলোকবাবুকে বলে কাল ওর খোঁজও করতে হবে। ও তো প্রাইম সাসপেক্ট।”
এরকম কথাবার্তা চলতে চলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি সত্যদা হাসি মুখে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। আমি হেডরেস্টে হেলান দিয়ে বসলে আমার হাতে গরম চায়ের কাপ তুলে দিলেন। আমার বুঝতে বাকি নেই। বাবু অঙ্কের সমাধান করে ফেলেছেন।
- “আমাকে ছেড়েই বেরিয়ে গেলে?” – অভিমানের সুরে বললাম।
- “খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে গেল বুঝলি, আর ঘুম আসছিল না। কেসটার সব বিষয়গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঘরে থাকতে না পেরে বেরিয়েই পরলাম। তোকে ডেকেছি দু একবার। তুই তো ঘুমে বিভোর তখন।”
সত্যদা ডেকেছিল জেনে লজ্জাই পেলাম। ঘুমালে তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না আমার। ইতিমধ্যে আওয়াজ দিতে দিতে অলোকবাবু চলে এলেন – “এই যে সত্য, তোর কথামত পুলিশ ডেকে নিয়েছি। পুলিশের গাড়ি আসছে।”
- “আয়ুশ, চটপট রেডি হয়ে নে।…অলোক তোকে একটু চা দেই।” – বলে সত্যদা ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢেলে অলোক বাবুকে দিলেন।
অলোক বাবুর সেলফোনটা বেজে উঠলো। “এই যে আই.সি. ফোন করেছে। কোথায় আসতে বলবো?”
- “চৌপথী পার করে শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে দাঁড়াতে বল।” – সত্যদা।
আমরা পৌঁছে দেখি পুলিশের একটা বোলেরো গাড়ি অপেক্ষা করছে। আই.সি.-এর ইশারায় আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারের পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। সেটা ধরেই আমরা কিছুটা এগোলে সত্যদার ইঙ্গিত মতন একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আমাদের গাড়ি। বাড়ির মালিক এগিয়ে এসে সত্যদাকে চিনতে পেরে সম্বোধন জানালে সত্যদা জানতে চাইলেন – “আপনার ভাড়াটিয়া ভদ্রলোক এখনও ঘুম থেকে ওঠেন নি নাকি?”
- “না, সে তো এইমাত্র তড়িঘড়ি করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল।” – আমতা আমতা করে জানালেন ভদ্রলোক।
- “মানে! কোন দিকে গেছে?”
ভদ্রলোক বাড়ির পাশের আরেকটা কাঁচা রাস্তা দেখিয়ে বললেন – “ওই ওদিকে গেছে।”
- “এক্ষুনি গেছে, তাইতো?” – আমি জানতে চাইলাম।
- “হ্যাঁ, আপনারা ঢোকার ঠিক আগেই বেরোলো। বেশিদূর যায়নি।”
আমাদের গাড়ি ভদ্রলোকের দেখানো কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটতে লাগলো। কিছুদূর পার হতেই দৃষ্টিপথে একটা বাইক দেখা গেল। সেও ছুটছে দুর্বার গতিতে। অপরাধী বলেই বারবার পেছনে দেখছে আর বাইকের গতি বাড়াচ্ছে। হঠাৎ একটা বুলেটের আওয়াজে সবাই স্তব্ধ। দেখা গেলো সামনের বাইকটি মাটিতে ছেঁচড়ে গেল। বাইক আরোহী রাস্তার পাশের নালার মধ্যে গিয়ে পড়লো। সত্যদা রিভলভারটা পকেটে পুরলেন আর আই.সি.-এর উদ্দেশ্যে বললেন – “স্পর্ধা মার্জনীয়”। জবাবে আই.সি. সাহেব হেসে বললেন – “নাইস শট।” আমাদের গাড়ি কাছাকাছি যেতেই লোকটি নালা থেকে উঠে পালাতে চেষ্টা করলেও আর তো কোনো লাভ নেই। বুলেট বাইকের টায়ার ভেদ করায় চারদিকে পোড়া একটা গন্ধ। কালপ্রিটকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলা হল।
ফেরার সময় বলে বসলাম – “সত্যদা, ঠিক জমলো না।”
- “কেন?”
- “প্রথম থেকেই মেইন সাসপেক্ট যে, সেই যদি অপরাধী হয়, তাহলে অলোকবাবুই তো সমাধান করে নিতে পারতেন। আমাদের আর কি দরকার ছিল।”
- “কে মেইন সাসপেক্ট?” – সত্যদা।
- “কেন, এই যে এই সার্ভে করার লোকটা, যে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ডেরা গেড়ে বসে আছে এ চত্বরে।”
অলোকবাবু হেসে উঠলেন – “না না, আয়ুশ, তোমার ভুল হচ্ছে। এ সে নয়।”
- “তাহলে?” – আমি জানতে চাইলাম।
- “এবার আমাদের একটু খোলাসা করে বলুন তো সত্য বাবু কি করে হদিশ করলেন এই অচেনা লোকটির।” – আই.সি.।
- “প্রথমত বড়শির কল থেকে বোঝা যায় যে এই মোহন দুটো শিবদিঘির নয়। এরপর বাণেশ্বরের এত খালবিলের কোনটা থেকে এদের ধরা হয়েছে সেটা বুঝবো কি করে। ভগবান নিজেই পথ দেখালেন। সেদিন, আই.সি. সাহেব আপনি ছিলেন না, কিন্তু একটা অদ্ভূত ব্যাপার আমরা সবাই দেখেছি। আমার ফেলে দেওয়া সিগারেটের টানে মোহন দুটো এগিয়ে এসে সিগারেটের বাটে মুখ দিয়ে ধূমপান করার চেষ্টা করছিল।”
- “কি বলছেন! স্ট্রেনজ্!”
- “ভাবুন তো কান্ড! সিগারেট একটা নেশা। সেটা যেমন মানুষকে কাবু করতে পারে, তেমনি পশুপাখিদেরও করতে বাধ্য। মানুষ অনেক উন্নত জীব। কোনো নেশা মানুষকে যতটা এফেক্ট করবে তার থেকে অনেক বেশি এফেক্ট করবে পশুপাখিদের। ডেভেলপমেন্টও একটা নেশা। এই যে ফোর-জি, ফাইভ-জি রেডিয়েশন,এতে মানুষের যা ক্ষতি হচ্ছে তার থেকে অনেক গুণ বেশি ক্ষতি হচ্ছে পাখিকূলের। আজকাল ড্রাইভ করার সময় লক্ষ্য করবেন অনেক সময়ই পাখিরা এসে গাড়িতে ধাক্কা খায়। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগেও এরকম টা ছিল না। গাড়ি আসছে তার হাওয়া বুঝে অনেক আগেই পাখিরা ফুরুৎ করে উড়ে যেত। সুনামির পূর্বাভাস যে পাখিরা সবার আগেই সেন্স করতে পারে, আজ রেডিয়েশনের প্রকোপে তাদের সেন্স অর্গান ক্রমাগত ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে কারোর কোনো নজর নেই। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের জোয়ারে আমরা নির্বিচারে গাছ কাটছি, বাস্তুতন্ত্রের ছোট ছোট পশুপাখি কীটপতঙ্গের বিনাশ করছি; পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছি। এর ফল যে কতটা ভয়ঙ্কর আমরা কেউই তা কল্পনা করতে পারছি না।”
সবাই চুপচাপ। অলোকবাবু বললেন – “থামলি কেন সত্য।”
- “যাই হোক, এখানে বুঝতে পারি যে মোহন দুটোর এই সিগারেটের নেশা দীর্ঘদিনের। তার মানে এরা এমন কোনও জলাশয়ের, যেখানে এরা জল থেকে উঠে এসে রোজ ধূমপানের আয়োজন পেয়ে থাকে। আজ সকালে এই চত্বরের সব খালবিল ঘুরে দেখতে গিয়ে এই বাড়িতে এসে আটকে যাই। ভাড়াটিয়া ভদ্রলোক প্রচুর স্মোক করেন আর সিগারেটের বাটগুলো ঘরের পেছনের জলাশয়ের ধারে ফেলেন। কূর্ম হলেও অবতার হয়ে এই ধরাধামেই তো বিরাজমান; সাধারণ নেশা আসক্তি কি করে উপেক্ষা করে তারা। আমি জানালা দিয়ে ভাড়াটিয়া ভদ্রলোকের ঘরে উঁকি মারলে ঘরের কোণে ঠিক একটা শক্তপোক্ত বড় বড়শি চোখে পড়ে। মাছ ধরার বড়শি এত শক্তপোক্ত হবার প্রয়োজন নেই। এরপর বাড়ির মালিকের সাথে সাধারণ আলাপচারিতায় জানতে পারি যে লোকটা বিহারের। কারোর সাথে বেশি মেলামেশা করে না, একা একাই থাকে। পাগলাটে গোছের, রাতবিরেতে নাকি পুকুর পাড়ে মাছ ধরতে বসে বড়শি নিয়ে। কি কাজ করে সেটাও স্পষ্ট না। বলে নাকি রাসায়নিকের ব্যবসা। সকালে ওনার ঘরে বস্তাবন্দী রাসায়নিকের প্যাকেটও দেখেছি। হয়তো, শিবদিঘির মোহনদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর পেছনে ওনার কোনো রাসায়নিকই দায়ি। সেটা আই.সি. সাহেব তদন্তে বের করতে পারবেন। বুঝতে আর বাকি থাকে না যে এই সেই কালপ্রিট।”
- “বাহ্ বাহ্, বেশ চমৎকার তো আপনার অবজারভেশন সত্য বাবু। অনেক শুনেছি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম” – মৃদু করতালিতে বাহবা জানালেন আই.সি.।
- “চমৎকার বলুন এই মোহনদের। ভগবান আজ নিজেই শয়তানকে ধরিয়ে দিলেন।” – সত্যদা।
অলোক বাবু দু হাত জোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে তারস্বরে বলে উঠলেন – “জয় মোহনের জয়।”